সেকেন্দ্রাবাদে নেমে গাড়ির খোঁজ করতেই হাল খারাপ হয়ে গেল কল্লোলিনীর । কী অদ্ভুত এদের ভাষা । হিন্দি – টিন্দি হলে সে চালিয়ে নিত , কিন্তু এ কী !!!
মনে করবেনা করবেনা করেও আজ মনে পড়ে গেল সিন্ধুর কথা । ও বলেছিল “তুমি যে কোম্পানি তে চাকরি করবে , আমিও ম্যানেজ করে সেই কোম্পানিতে চাকরি যোগার করে নেব । দেখো । তাহলে দুজনে একই জায়গায় থাকতে পারব” ।
সেসব ওদের সোনালী দিনের কথা । খুব ভালবাসত তাকে ছেলেটা । আর সে ? সে ও কী ভালবাসত ? কে জানে । চার চারটে বছরের রিলেশনেও এটা ওর কাছে স্পষ্ট হয়নি যে আদৌ ওর মনে সিন্ধুর জন্য কোনো ভালবাসা ছিল কিনা । প্রথম কৌশোরের সেই উন্মাদনা, ওর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিন্ধুকে প্রপোজ করা কি সত্যি ছিল না শুধুই হরমোনের কারসাজি ছিল, সেই নিয়েও যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে ওর মনে । এটা সত্যি যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মনের কোন গোপন কোণে সিন্ধুর জন্য একটা চাপা বিরক্তি বা ঘৃণা তৈরি হচ্ছিল, তবে অজান্তে নয়, অভ্যাসের আড়ালে । বুঝতে পারত কি সিন্ধু ? সেই জন্যই কি ? তার জন্য প্রায় সব কিছু করতে প্রস্তুত ছেলেটা, তাকে সব সময় খুশী রাখার চেষ্টা করা, তার আরামের জন্য নিজেকে উজার করে দেওয়া ছেলেটা একদিন হঠাত মাত্র একদিনের নোটিশে সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিল । যে সম্পর্কটা বার বার কল্লোলিনী নিজে ভাঙ্গতে গেছে আর প্রাণপণের চেষ্টায় জোড়াতালি দিয়ে ধরে রেখেছে সিন্ধু । তখন অবশ্য খুব কেঁদেছিল কল্লোলিনী । এখন বোঝে সেটা আসলে অধিকার হারানোর কষ্ট । ভালবাসা হয়ত নয় ।
উল্টোপাল্টা আকাশ পাতাল ভাবার মাঝেই একটা গাড়ি পেয়ে গেল কল্লোলীনি । এখানে সবই অদ্ভুত । অটোতেও মিটার লাগান । ভাড়া বেশ বেশী । প্রথম প্রথম ভাবছিল চাকরিটা বেশ ভাল মাইনের । কিন্তু এখন দেখছে এই রেটে প্রতিদিন ভাড়া গুণতে হলে মাসের শেষে তো জমানোর মত কিছুই থাকবে না ।
অরূপের সঙ্গে তার সম্পর্কটা হঠাত করেই তৈরি হয়েছিল । কলেজের বন্ধু । বিভিন্ন টাস্ক সল্ভ করতে হেল্প করত ওকে । কিভাবে যেন কল্লোলিনীর খুব কাছের হয়ে উঠেছিল অরূপ । সব সময় ওর সঙ্গেই গল্প আড্ডা এস এম এস । সিন্ধুর বোঝার ক্ষমতা ছিল সাধারণ মানুষের থেকে বেশ কিছুটা বেশী । সে জানতে পেরেছিল । কিভাবে সেটা জানেনা কল্লোলিনী । সিন্ধু কিছু বলেনি । শুধু তার মৃদু অনুযোগ ছিল সবটুকু সময় অরূপকে দিয়ে দেওয়া নিয়ে ।
যখন কল্লোলিনীর কোনো বন্ধু ছিল না তখন তো সবটুকু সময়ের সমস্ত কথার চাহিদা মেটাতো সিন্ধু । এখন সবটুকু না হলেও কিছুটা সময় সে চাইছিল কিন্তু কল্লোলিনীর পড়াশোনার মাঝে সময় হচ্ছিল না তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার । অন্তত সে সেটাই বলেছিল, কিন্তু সে নিজে তো জানে, তখন সে মশগুল ছিল অরূপের সঙ্গে একের পর এক এস এম এস এ । নিজের কাছে তার নিজের জবাব তৈরিই ছিল । সে তো আর অরূপের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছেনা । জাস্ট ফ্রেন্ড । যদিও এখন সে বোঝে নিজের অজান্তে কখনও কখনও শীতের সন্ধ্যেয় অরূপকে নিয়ে লুকিয়ে ফ্যান্টাসী করার লজ্জাটা অন্যের কাছে চাপা গেলেও নিজের কাছে যায় না । আর হয়ত সিন্ধুর কাছেও চাপা যায়নি । আপাতঃদৃষ্টিতে পাগলা টাইপ ছেলেটার অন্তর্দৃষ্টিকে সে প্রতিদিন অস্বিকার করে আসলেও মনে মনে তার অস্তিত্বকে সমীহ করত ।
কেন হঠাত সিন্ধু সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিয়েছিল সেটা আজও বোঝেনা কল্লোলিনী । প্রতিহিংসা, বেটর অপশন এর মত কোনো একটা কারণ ধরে নিতেই পারত কিন্তু ব্যাপারটা এলোমেলো হয়ে গেছিল ঠিক ছ মাস পরে সিন্ধুর আবার ফিরে আসতে চাওয়ায় ।
স্ট্রেটকাট না করে দিয়েছিল সে । বলেছিল তার এখন আর কিছু যায় আসেনা সিন্ধু তার জীবনে থাকল কি না থাকল । আসলে সে মনে মনে শোধ নেওয়ার স্বাদটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল । মশলা হিসাবে ছিল ছ মাসে একটু একটু করে সঞ্চয় করা “স্বাধীন” পিছুটানহীন জীবন উপভোগ করার সাহস ।
আর যোগাযোগ রাখেনি । তার পর হঠাতই একদিন উধাও হয়ে গেল সিন্ধু । যোগাযোগ না রাখলেও ফেসবুকের প্রোফাইল আপডেট বা হোয়াটসঅ্যাপের স্টেটাস মাঝে মাঝেই চোখে পড়ত । একদিন সব হটাত করেই গায়েব হয়ে গেল । কৌতুহল বশতঃ তাদের দু এক জন কমোন বন্ধুকে কথাচ্ছলে জিজ্ঞেসও করেছিল কল্লোলিনী । কিছু জানেনা কেউই ।
মাঝে সিন্ধুর বাবা মা তিন দিনের ব্যবধানে চলে গেলেন হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে । শুনেছে মাত্র মিনিট ৪০ এর জন্য এসেছিল সিন্ধু । একদম নাকি বদলে গেছে । চোখে সব সময় রোদ চশমা, পেটানো শরীর, ছোট ছোট করে কাটা চুল । চলন্ত রোবটের মত । আবার চলে গেছে । কানাঘুষোয় বন্ধুদের নানা আন্দাজ শুনতে পেয়েছে কল্লোলিনী । সুইসাইড কম্যান্ডো স্কোয়াড জয়েন করেছে সিন্ধু ।
কদিন আগে ব্রতিপ্রিয়াদের বাড়ি যাওয়ার সময় সিন্ধুদের বাড়িটা দূর থেকে চোখে পড়েছে কল্লোলিনীর । মাত্র একবারই এসেছিল সে । গেটের বাইরে থেকেই চলে গেছিল নিজের আভিজাত্য বজায় রেখে । সিন্ধু তাকে বার বার ঘরের ভিতরে আসার জন্য অনুনয় করেছিল । একান্ত ব্যক্তিগত ঘরে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর জন্য নয় , মায়ের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য । আসলে কল্লোলিনীকে বিয়ে করে একটা সুখি সংসারের স্বপ্ন দেখত তো “মিডলক্লাস মাইন্ডেড” সিন্ধু । বাড়িটা পোড়োবাড়ির মত দেখতে লাগছে সন্ধ্যের অন্ধকারে । তালামারা, পাঁচিলে অযত্নের শ্যেওলা ধরা বাড়িটা কি কোনো ভাবে তার দিকে আঙ্গুল তুলছে ? নাহ , তার কি করার আছে ? সে তো আর সম্পর্কটা ভাঙ্গেনি । আর তা ছাড়া যার যার নিজের জীবন, কি করবে সেটা নিজের সিদ্ধান্ত । অন্য কারুর তাতে কিছু বলার অধিকার নেই ।
কোম্পানিতে জয়েন করার পরের দু দিন ছুটি দিয়েছে অফিস । উচ্ছল স্বভাবের কল্লোলিনী সকালটা ঘুমিয়ে কাটাল আর বিকেল বেলায় বের হল একটু সাইট সি ইং এ । নিজাম প্যালেস, ক্লক মিউজিয়াম, ফিল্ম সিটির ঝটিকা সফর করে কল্লোলিনী এসে নামল বাঞ্জারা হীলস এ । ও যে বাড়িতে পেইং গেস্ট আছে সেটা এখান থেকে ২ মিনিটের পথ । রাস্তাঘাট চিনতে হবে তো ।
যেতে যেতে একটা বিশাল পাথরের মূর্তি দেখতে পেল কল্লোলিনী । অপূর্ব সুন্দর একটা নারীমূর্তি । বেশ প্রাচীন বলেই মনে হল । কৌতূহলী হয়ে আশেপাশের কয়েকজন কে জিজ্ঞাসা করে যেটুকু বুঝতে পারল তা হল এটা কোনো এক রাজ কণ্যার মূর্তি । তাঁর প্রেমিক ছিলেন একজন বড় শিল্পী । তিনিই এটা বানিয়েছিলেন ।
কল্লোলিনী যে বাড়িতে পেইং গেষ্ট আছে সেই বাড়িটা আঞ্জুন্মা বলে একজন মধ্যবয়সী মহিলার । ইতিহাসের গবেষক । খুব ভাল মানুষ, চমৎকার ইংরাজী বলেন । একদিনেই তার সঙ্গে দারুণ জমে গেছে কল্লোলিনীর । বেড়ানোর গল্প করছিল সে । আসার পথে দেখা মূর্তিটার কথা শুনে আঞ্জুন্মা বললেন যে ওর একটা বড় ইতিহাস আছে ।
ওই মূর্তিটা রাজকণ্যা ঐশীতার । আর ঐ তরুণ ভাস্কর থাকতেন এই পাহাড়ে । একদিন পথ দিয়ে যেতে যেতে ভাস্করের কাজ দেখে মুগ্ধ হন রাজকণ্যা । উচ্ছসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দেন । ভাস্কর চমৎকৃত হন । দুজনের কথাবার্তা বাড়তে থাকে । বন্ধুত্বও বাড়তে থাকে । রাজকণ্যাকে ভালবেসে ফেলেন ভাস্কর । কিন্তু রাজকণ্যা ঐশিতা ভালবাসতেন পাশের রাজ্যের রাজকুমার চাক্যলৈতস কে । তাঁদের দুজনের বিবাহ ও হয়ে যায় একদিন । মন ভেঙ্গে যাওয়া ভাস্কর দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে সমস্ত কাজ ফেলে বানাতে থাকেন রাজকণ্যার মূর্তি । ঐ মূর্তি তৈরীকরার পরে আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বেঁচেছিলেন ভাস্কর । স্থানীয় লোকেরা ইতিহাস বিশেষ জানেনা তো । তাই বলে যে ওই ভাস্কর আর রাজকণ্যা প্রেমিক প্রেমিকা ছিল ।
আর রাজকণ্যা ? জিজ্ঞেস করল কল্লোলিনী ।
রাজকণ্যা স্বামী পুত্র নিয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত সুখে সংসার করেছিল ।
দক্ষিণী খানায় অনভ্যস্ত, অতি কষ্টে ডীনার সারল । ঘুম আসছিল না তাই রাতের শহরটাকে দেখার জন্য ছাদে উঠল কল্লোলিনী । অসাধারণ মায়াময় । কলকাতার রাতের কথা মনে পড়ে গেল । মূর্তিটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার কথা কিন্তু দেখা যাচ্ছেনা । কুয়াশা হয়েছে নাকি ?
“আমায় খুঁজছ ?” অতর্কিত প্রশ্নে ভীষন চমকে পিছন ঘুরল কল্লোলিনী । ছায়াশরীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজকণ্যা ঐশীতা ।
“ভয় পেয়োনা । আমি আমার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছি ”
বলতে বলতেই আরেক সুদর্শন যুবা ছায়াশরীর ধরে আবির্ভূত হলেন । কিন্তু তাঁর কটি বন্ধে তলোয়ার ঝোলানো নেই । আছে হাতুরি বাটালী ।
“কী ? অবাক হচ্ছ ? আমি ভাস্কর । রাজকণ্যার প্রেমিক । আমরা হলাম সূক্ষ অতীত, যা বেঁচে থাকে মানুষের মনে । মানুষ আমার কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের দুজনকেই মনে রেখেছে । প্রেমিক প্রেমিকা হিসাবে আমরা রয়ে গেছি । হাজার মানুষের চিন্তায় আমরা পেয়েছি ছায়াশরীর ।”
শুনতে শুনতে চারপাশ অস্পষ্ট হয়ে এল কল্লোলিনীর ।
খাবার সহ্য না হলে সবারই প্রথম প্রথম এরকম একটু শরীর খারাপ হয় । অঞ্জুন্মা ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছেন একদম নিজের বাড়ির লোকের মত । কালই অফিসে যেতে পারবে কল্লোলিনী ।
ব্যাগ হাতরে একটা পেনড্রাইভ বার করল কল্লোলিনী । এটা তার জন্মদিনে উপহার হিসেবে দিয়েছিল সিন্ধু । বলেছিল “আমার তো এখন বেশী সামর্থ্য নেই । যখন চাকরী করব তখন তোমাকে জন্ম দিনে ভাল কিছু দিতে পারব” । পেনড্রাইভ তার অনেকগুলো আছে । তবু এটাকে সে রেখে দিয়েছে । এর মধ্যে থাকা কয়েকটা জয়েন্ট ফটো ও সে রেখে দিয়েছে । এটা আজ সে ফেলে দেবে কোনো দুর্গম জায়গায় । যেখান থেকে ইচ্ছা হলেও সে আর কুড়িয়ে আনতে না পারে । এখন ভূত ছেড়ে ভবিষ্যতে পা দেওয়ার সময় । অনেকটা জীবন পড়ে আছে বেঁচে নেওয়ার জন্য ।
কে বলতে পারে পেনড্রাইভটা রয়ে গেলে কোনোদিন সে দুটো কিশোর কিশোরীর হাতে হাত ধরে সাইকেল নিয়ে ঘোরা ছায়াশরীর দেখবেনা ?