বিকেল ৫ টা ৪৯ ।
মাননীয় বিধায়ক শিববাবু এসে হাজির হয়েছেন “বোকাচক যুবক সঙ্ঘে” । শিববাবু সাধারণতঃ ভোটে জেতার প্রায় সাড়ে চার বছর পর এলাকায় আসেন সবার অভাব অভিযোগ শুনে সমাধানের আশ্বাস দিতে । এই নিয়মই চলে আসছে গত প্রায় ১৫ বছর ধরে তাঁর একক সংখ্যাগরিষ্টতার আমলে । অবশ্য এবারে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আসতে হয়েছে তাঁকে । তাঁর বিধায়ক তহবিলের বদান্য অনুগ্রহে নবনির্মিত ক্লাবের দ্বিতলটি উদ্বোধন করতেই ভোটের তিন বছর পর নিয়ম ভেঙ্গে তাঁর শুভাগমন । ক্লাবের স্নেহাস্পদ বাচ্চা ছেলেগুলোর বড্ড অসুবিধা হচ্ছিল শীতের রাতে শরীর গরম করতে । একতলার ঐ হাট করা ঘরে তো আর যাই হোক তুলে আনা হাতে গরম কোচিংফেরতা মালপোয়া চাখা যায় না ।
খুঁতখোঁজা সমাজের দৃষ্টি মদীর করতে বেশী কন্যাপণ ভবিতব্য হওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে জেনেও অনেক অকালে গাল তুবড়ে যাওয়া বাবা আজকের বিশাল লোক সমাগমে অংশ নিয়েছে । কারণ উপস্থিত বাকি জনতার মতই তাদেরও প্রতিদিনই দেখা হয় ক্লাবের কোমলমতি বাচ্চা ছেলেগুলোর সঙ্গে । এবং আরও কিছু বছর দেখা হয়ে যাওয়ার জন্য সজীব উপস্থিতি খুব দরকার তাদের পরিবারের পেটে দুটো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য এটা বোঝে না এমন বোকা কেউ নেই বোকাচক গ্রামে ।
রক্তিমবর্ণ চোখ ভরা হাসি নিয়ে রীতি মেনে জোড় হাতে লালবাতির দুধ সাদা গাড়ি থেকে নামলেন শিব বাবু । আর তখনই হঠাত ঘটল সেই কান্ডটা ।
প্রচণ্ড জয়ধ্বনী ছাপিয়ে একটা কানফাটা আওয়াজ । শিব বাবু প্রচন্ড আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লেন । হাত বুক ছুঁতে চেষ্টা করল কিন্তু কোমর পর্যন্ত পৌঁছানোর সাথেই নিথর হয়ে গেল আর ট্রিপল এক্স সাইজের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবীর বুকটা লাল হয়ে যেতে থাকল ।
শিববাবুকে অ্যাম্বুলেন্সে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া আর ভীড়ে শুরু হয়ে যাওয়া প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি সামলাতে বেসামাল পুলিশ কিছুতেই ট্রেস করতে পারল না কে সেই অদৃশ্য আততায়ী । শুধু হাজার হাজার পায়ের ছাপের সাক্ষর সম্বলিত একটা পোস্টার তুলে নিয়ে গেল সন্দেহজনক হিসেবে ।
সন্ধ্যা ৬ টা ১৫ ।
গ্যালভানাইজিং প্ল্যান্টের পাশে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রোডাক্ট দেখছেন “মিকারা বিমস লিমিটেড” এর মালিক দৌলতরাম বাজোরিয়া । সঙ্গে ছেলে উপেন্দ্র । ছেলের বয়স ১৯, কোম্পানির ভবিষ্যত ।
টগবগ করে ফুটতে থাকা জিঙ্কের পিট, পাশে ঠান্ডা জল গরম জল আর অ্যাসিডের পিট । গলানো লোহা থেকে তৈরী বিম এসে এই প্ল্যান্টে রৌপ্যকান্তি ফাইনাল টাচ পায় ।
এছাড়াও আরেকটা পরিচয় আছে কারখানার এই অংশটার । মালিকের বিভিন্ন সমস্যা থেকে চিরকাল সহজ মুক্তি দিয়ে এসেছে এই গ্যালভানাইজিং বা সংক্ষেপে জি-আই প্ল্যান্ট । কারখানার অবহেলিত যন্ত্রপাতির হঠাত অভিঘাতে মৃত বা গুরুতর জখম লেবারের ক্ষতিপূরণ বা চিকিৎসার জন্য প্রদেয় টাকাটা বহুবার বাঁচিয়ে দিয়েছে এই জি-আই প্ল্যান্ট । অদ্ভুত ক্ষমতা ঐ গলানো দস্তার গহ্বরের । গোটা মানুষ ফেলে দাও । একসেকেন্ডের মধ্যে গোটাটাই ভ্যানিস । কিচ্ছু পাওয়া যাবেনা, হাড়ের কুচিটাও না । বরং ওর থেকে বেশী সময় লাগে সেদিনের অ্যাটেন্ডেন্স গায়েব করতে । শুধু কি তাই ? লেবারদের মধ্যে যাদেরই নেতা হওয়ার শখ জেগেছে সেই হাতগুলো যাতে কোনোদিনই হাতে হাতে মানব শৃঙ্খল তৈরী করতে না পারে তা বরাবর নিশ্চিত করেছে এই জি-আই প্ল্যান্ট ।
উপেন্দ্রকে চিনিয়ে রাখা খুবই দরকার, ভবিষ্যতে ওর কাজে লাগবে ।
হঠাতই পাওয়ার অফ হয়ে গেল ফ্যাক্টরীর । মিশকালো অন্ধকারে জি-আই প্ল্যান্টের এত কাছাকাছি থেকে এত বছর বাদে এই প্রথম দৌলতরামের মনে হল এরকম পরিস্থিতির জন্য একটা ইনভার্টার সিস্টেমের থাকা দরকার ছিল । সেসময়ই দৌলতরামের ভীষণ চেনা একটা কন্ঠস্বরে একটা আর্তচীৎকার খান খান করে দিল যন্ত্রের আওয়াজ থেমে হঠাত নীরব ফ্যাক্টরিটা । সেই আর্তনাদে সঙ্গত করল তরল দস্তায় ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ আর বিজাতীয় দ্রব্য পড়লে হওয়া দস্তার বিস্ফোরণের চেনা শব্দ ।
ঠিক তখনই ফ্যাক্টরীর ডিজেল জেনারেটরটা সশব্দে আলোকিত করে তুলল চারদিক । উপেন্দ্র নেই ।
এই প্রথমবার জি-আই প্ল্যান্টে পুলিশ এল তদন্তে আর স্বাভাবিক ভাবেই সংগ্রহ করার মত কিছু স্যাম্পেল না পেয়ে একটা ছেঁড়াখোঁড়া পোস্টারের সঙ্গে কয়েকজন হচচকিত শ্রমিকের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ।
রাত ৭ টা ৩ ।
ভাল ক্যাম্পাসিং এর নাম করে নেওয়া লাখ লাখ টাকার প্রায় ৫ শতাংশ যে এভাবে খরচা করতে হতে পারে ভাবতে পারেন নি এম এন সি আর আই কলেজের ডিরেক্টর সাহেব । শালা শুয়োরের বাচ্চা স্টুডেন্টগুলো সেই কখন থেকে ঘেরাও করে রেখেছে । বাধ্য হয়েই পঞ্চা ভাইকে ফোন দিতে হল দলবল নিয়ে আসার জন্য ।
ঐ বোধ হয় এসে গেল পঞ্চার দল । আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে ওরা এগিয়ে আসছে ওঁর দরজার সামনে । আগে ওঁকে বের করে নিয়ে যাবে তার পর অ্যাকশন শুরু হবে । ওদের আজ হেব্বি মজা । স্টুডেন্টদের মধ্যে আজ ক’টা ডবকা মেয়েও আছে যে ।
পঞ্চার দল এসে গেছে দরজা খুলে ঢুকে ওনার দিকে তাকিয়ে একটা মুশকিল আসান মার্কা হাসি হেসে বলল “মাল্লু এখানেই রেডি আছে নাকি কাল গিয়ে নিয়ে আসতে হবে ?” উনি উত্তর দিতে যাওয়ার আগেই ঘটল ঘটনাটা ।
বাইরে থেকে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল মিষ্টি দেখতে ই সি ই ট্রেডের মেয়েটা । কোমরে বাঁধা তার বেরিয়ে থাকা লম্বা লম্বা লাঠির মত জিনিস গুলো ওর ঠোঁটের লিপস্টিকের মতই লাল । হতচকিত সবার দিকে একটা মুচকি হাসি আর বাঁ চোখটা একবার টিপেই হাতের ছোট্ট রিমোটটার বোতামে চাপ । মুহুর্তে কান ফাটানো আওয়াজ আর লক্ষ ক্যামেরার ফ্ল্যাশে যেন ঝলসে গেল ওদের চোখ । অতিকষ্টে যখন যন্ত্রণাময় চোখ খুলতে পারলেন ডিরেক্টর সাহেব তখন অনেকটা সময় কেটে গেছে । এদিক ওদিক ঠিকরে পড়ে আছে পঞ্চার দলের সদস্যরা, সংজ্ঞাহীন । সামনে কয়েকতাল মাংস । মেয়েটার জামা আর অন্তর্বাসের কয়েকটা টুকরো । যাক তাহলে প্রাণে বেঁচে গেছেন ভেবে আনন্দের আতিশয্যে উঠে বসতে যেতেই উপলব্ধী করলেন কাঠপুতুলের মত শরীরটায় শুধু প্রাণটাই আছে , নেই নড়াচড়া করার ক্ষমতা । কোথায় যেন পড়েছিলেন মাথায় আঘাতে প্যারালিসিসের কথা ।
আবার পুলিশ, আবার একটা পোষ্টার আর এর পর সারা রাত ধরে আলাদা আলাদা জায়গায় এক সিরিজে ঘটতে থাকা এরকমই কিছু ঘটনা । মিডিয়ায় সঙ্গে সুমন ইত্যাদি আর নীচের বুলেটিন স্ট্রিপে ব্রেকিং তকমা ।
* * * * * * *
দিন তিনেক পরের কথা ,
মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ জেনেছে যে শিববাবুর বুকের লাল রঙটা আলতা ভরা বেলুন আর সংজ্ঞাহীনতাটা কোমরে বিঁধে থাকা ব্লো অ্যারোর প্রভাব ।
উপেন্দ্র বাজোরিয়াকে আজ সকালে তার বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে গেছে অজ্ঞাত পরিচয় কিছু অপহরণকারী ।
ডিরেক্টরের ঘরে পড়ে থাকা মাংসটা পাঁঠার । তাঁর ইঞ্জেকশনের প্রভাবে স্টিমুল্যেটেড পক্ষাঘাত কেটেছে আজ নার্সিংহোমের ট্রিটমেন্টে । তাঁর ঘর থেকে বেধড়ক ক্যালানিতে আহত পঞ্চার দলের সঙ্গেই মিলেছে একটা অ্যানাস্থেটিক স্মোকবোম্বের কয়েকটা টুকরো ।
এরকমই আরও ঘটনার কিছু অপ্রত্যাশিত ক্লাইম্যাক্স ।
.
.
.
মাসটা এপ্রিল না হলেও আজন্ম মেষ রাশির জনগণ জোকটা নিত্যদিনের একঘেয়েমির মাঝে ঝাল চানাচুরের মতই নিয়েছে স্পোর্টিংলি ।
শুধু প্র্যাঙ্কড কয়েকজনের চোখে ঘুম নেই ।
পুলিশ কমিশনারের ঘরের বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো পোস্টার গুলো যে ওরা সবাই দেখেছে । এখনও মুক্তি না পাওয়া আলাদা আলাদা সিনেমার পোস্টার । প্রতিটার নীচেই বড় বড় করে লেখা “Coming Soon …”