গুপ্তশত্রুর সন্ধানে, পর্ব -১ (রংবাজী)
ছোটবেলায় বাবা একটু রঙচঙা মিষ্টি দেখলেই বলত, “খাসনা, রঙ দেওয়া আছে”। অনেকেই বলেন, এবং সযত্নে পরিহার করে চলেন বিভিন্ন রঙিন শরবত ইত্যাদি, এই বেপরোয়া বয়সের যুগে অনেক টিনেজারও স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে রঙিন খাদ্যবস্তুকে এড়িয়ে চলে, এটা একটা ইতিবাচক প্রবণতা। কিন্তু এর মাধ্যমে আদৌ কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারছি অস্বাস্থ্যকর রঙ দেওয়া খাবার ???
উত্তরটা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক, না আমরা পারছি না বরং আমাদের প্রতিদিনের খাবারের প্রায় ৭০% বস্তুতেই মিশিয়ে দেওয়া আছে কৃত্রিম রঙ, যা শুধু নিছক রঙ নয়, প্রাণঘাতি কার্সিনোজেন (যে পদার্থ শরীরে অবধারিত ভাবে ক্যানসার তৈরী করে)।
আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব এমন একটি জিনিসের সঙ্গে যেটি শুধু বিভিন্ন বাইরের খাবারেই মেশানো থাকে না, আমরা নিজেরাও সম্পূর্ণ অশিক্ষিতের মত বাজার থেকে কিনে এনে বাড়ির খাবারে মেশাই। অশিক্ষিত বললাম কেন ??? কারণ এই প্রোডাক্টটির গায়ে প্রস্তুত কর্তারা ছোট ছোট হরফে হলেও “FOR INDUSTRIAL USE ONLY, NOT FOR HUMAN CONSUMPTION” লিখে নিজেদের আইনগত ভাবে বাঁচার রাস্তা পরিস্কার করে রেখেছে। আর আমরা সেই লেখা পড়ে দেখারও প্রয়োজন মনে না করে যথেচ্ছ পরিমাণে বিষ ইচ্ছাকৃত ভাবে খেয়ে চলেছি প্রতিদিন। আজ্ঞে হ্যাঁ বিষ, ফুডকালারিং হিসাবে ব্যবহার করলেও এটিকে “বিষ” বলে অভিহিত করলে কিছু মাত্র ভুল হবে না।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল বেশ কিছুদিন আগে আমেরিকার এক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতার একটি অত্যন্ত ঐতিহ্যশালী বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। আমার জিগরি দোস্ত এই গবেষনায় যুক্ত থাকার সুবাদে আমিও কাঠবেরালির মত সেতু বন্ধনে সাহায্য করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাজার থেকে গুঁড়ো হলুদ ও গুঁড়ো লঙ্কার স্যাম্পেল সংগ্রহ করার দায়িত্ব বর্তেছিল আমার উপর। সেই মত বিভিন্ন বাজার ঘুরে বহু আনপ্যাকেজড হলুদ, লঙ্কা গুঁড়োর পাশাপাশি বেশ কিছু নামী দামী কম্পানির প্যাকেজড টারমারিক পাউডার আর চিলি পাউডারের প্যাকেটও সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম। আর দিয়েছিলাম একটা কামধেনু রঙের প্যাকেট, কৌতুহল বশতঃ। পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একদিন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি পাওয়া গেল ? সে জানিয়েছিল লুজ বিক্রি হওয়া গুঁড়োয় ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ আর প্যাকেজড গুলোয় ১২ থেকে ৩৫ শতাংশ কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক রঙ উপস্থিত। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আর কামধেনু ? সে হেসে বলেছিল, “ভাই ওটা পুরো খাঁটি” , আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করায় সে জানায় ওটির ১০০ শতাংশই খাঁটি বিষ, অর্থাৎ কার্সিনোজেনিক কেমিক্যাল।
হ্যাঁ এই স্টিং রিপোর্টের প্রথম পর্বে আমি কামধেনু রঙ সম্বন্ধে বলব। অনেকেই এই লেখা পড়ে অবাক হচ্ছেন, কারণ এই রঙ এতদিন তাঁরা নির্বিচারে ব্যবহার করে এসেছেন বাড়িতে বিরিয়ানী বানাতে। যাঁরা নিজেরা কখনও দোকান থেকে কেনেননি বা বিরিয়ানি খান না তাঁদেরও আশ্বস্ত হবার কিছু নেই, শুধু হোটেলের বিরিয়ানি বা লাল লাল মাংসের ঝোল ই নয় , পাড়ার ফুটপাথে টিকিয়া চাট বা ঘুঘনি খেয়েছেন তো ? কিম্বা বিভিন্ন ফাস্টফুডের সঙ্গে দেওয়া টুকটুকে লাল সস ? কিম্বা ফলের দোকানে বিক্রি হওয়া চেরী ? এসব খান না ? আচ্ছা বেশ, লাল টুকটুকে ডালিম কিম্বা বাজারের সেরা টাটকা মাছ, যেটার লাল টকটকে রক্ত দেখে তাজা মাছ ভেবে কিনেছেন ? কিম্বা দোকান থেকে কেনা সোনার মত রঙের অঢ়র (অরহর) ডাল ? —— এসবের সব কটাতেই এবং আরও নানা খাবারে ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিশিয়ে দিচ্ছে কামধেনু রঙ। যা শুধু নিছক রঙ নয়, ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী বিষ।
বাজারে প্রধানতঃ দু ধরণের কামধেনু রঙ বেশী প্রচলিত। লাল আর হলুদ। কমবেশি সব মুদিখানার দোকানে পাওয়া যায়। বাড়িতে বিরিয়ানি করলে দোকানের মত সাজাতে এই রঙ বাঙালীর চাই ই চাই। বর্তমানে শুধু কামধেনুই নয়, তাকে নকল করে আরও কয়েকটি কোম্পানি বাজার ধরতে নেমে পড়েছে। এসব রঙের প্যাকেটের পিছনে ছোট ছোট হরফে সাবধানবাণী লেখা থাকলেও এরা ইচ্ছাকৃত ভাবে প্যাকেটের ভাঁজ এমন ভাবে করে যে ঐ সাবধানবাণী প্যাকেটের ভাঁজে ঢাকা পড়ে যায়। জনসচেতনতা না থাকায় এবং অতিরিক্ত লাভের আশায় মুদিখানাগুলিও খাবার রঙ বলে নির্বিচারে এগুলি বিক্রি করে।
আসুন দেখে নেওয়া যাক কি আছে এই কামধেনু রঙে। হলুদ রঙটি হল মেটানিল ইয়েলো (C18 H14 N3 Na O3 S) আর লাল রঙটি হল এস এস রেড (potassium dichromate – K2 Cr2 O7). এই দুটি রাসায়নিকই এতটা ভয়ঙ্কর যে এর একটা বিন্দুও ক্যানসার ডেকে আনতে পারে। তাই ল্যাবরেটরিতে এগুলি নিয়ে কাজ করার সময় গ্লাভস ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও মেটানিল ইয়েলো ক্যানসারের পাশাপাশি আরও কিছু দীর্ঘস্থায়ী অসুখ তৈরী করতে পারে, যেমন অ্যালঝাইমার্স, প্যারানৈয়া, ইন্সোমনিয়া, কিডনি স্টোন, ব্রেণের ও নার্ভের বিভিন্ন সমস্যা। বিভিন্ন ক্লিনিকাল ট্রায়ালে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই কেমিক্যাল শরীরে একবার ঢুকলে তার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। এমনকি মায়ের শরীরে থাকা এই কেমিক্যালের প্রভাবে বাচ্চার মস্তিষ্কের গঠন ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।
Potassium Dichromate রাসায়নিকটি অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি পদার্থ যার প্রভাবে ক্যানসার ছাড়াও আমাদের শ্বসনতন্ত্র মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা দেখা যায়। এছাড়াও থাইরয়েড গ্ল্যান্ড, কিডনি, লিভার, লাংস, পাকস্থলি, জননতন্ত্র ইত্যাদিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল সম্ভবনা থাকে।
কি করে বোঝা যায় কোন খাদ্যে এই প্রাণঘাতী বিষ মেশানো আছে কিনা ? বোঝা খুবই শক্ত। ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করা ছাড়া উপায় নেই, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা হিসাবে দেখা হয় রঙ পরিবর্তন (মেটানিল ইয়েলো ঘন হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সংস্পর্শে এলে গোলাপী বর্ণ ধারণ করে আর পটাশিয়াম ডাইক্রোমেট সালফার ডাইঅক্সাইডের সংস্পর্শে ঘন নীলবর্ণ ধারণ করে)।
এই ভয়ংকর বিষের হাত থেকে বাঁচার রাস্তা কি ? চোখ কান খোলা রাখুন। দোকান থেকে এই কামধেনু রঙ কিনে ব্যবহার করা বন্ধ করুন, দোকানদার কে বোঝান যাতে তিনি এই বিষ দোকানে না রাখেন, আরও যাঁরা যাঁরা কেনেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন, তাঁদেরও বোঝান, সচেতন করুন। রাস্তাঘাটের বেশী রঙচঙ্গা খাবার এড়িয়ে চলুন । পরিচিত কেউ যদি ঘুঘনি বা আচার বা সস ইত্যাদি প্রস্তুত করার ব্যবসায়ে যুক্ত থাকেন তাহলে তাঁদেরকে সচেতন করুন। জনসচেতনতা ছাড়া এই সমস্যার অন্যকোন সমাধান আমাদের হাতে এই মুহুর্তে নেই। সরকার যদি দায়িত্ব নিয়ে এই রঙকে ডোমেস্টিক ইউজের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে বা নিদেনপক্ষে এর প্যাকেটের সামনে বড় বড় অক্ষরে পয়জন বা বিষ লেখা বাধ্যতামূলক করে দেয়, তাহলে কিছুটা কাজ হতে পারে।
অনেকে জিজ্ঞাসা করতেই পারেন, তাহলে খাবার রঙ করার বিকল্প ব্যবস্থা কি ? তাঁদের বলি যে রঙ গুলিতে ফুড কালারিং কথাটি লেখা থাকবে এবং fssai লেখা থাকবে একমাত্র সেই রঙগুলিই খাবার রঙ করতে ব্যবহার করবেন। আর কেউ অনুমোদনহীন রঙ দিয়ে খাবার বানিয়ে তা বিক্রি করলে FSSAI এর কাছে অভিযোগ করার পূর্ণ অধিকার আপনার কিন্তু সবসময় রয়েছে।
এই লেখাটি শেয়ার করুন যতভাবে পারেন, ইচ্ছা হলে কপি পেস্ট করুন, সচেতনতা ছড়িয়ে দিন। খুব শিগগীরই ফিরে আসছি “গুপ্তশ্ত্রু” সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে।