আগাছা না বনৌষধি ? – ১

নমস্কার পাঠকবর্গ। আগের লেখাটিতেই আমি ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলাম, পরিচিত হয়েও অপরিচিত উদ্ভিদগুলির ব্যবহার ও ভেষজ গুণগুলি নিয়ে লিখব। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা যে কি ভীষণ দুরুহ তা অনুভূত হল, যখন দেখলাম আগাছা, অর্থাৎ যে উদ্ভিদেরা নিতান্তই অবহেলায় যেখানে সেখানে বেড়ে ওঠে ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকে, আধুনিক ভেষজবিজ্ঞানে তাদের নিয়ে গবেষণা অত্যন্ত দুর্লভ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বন্দময়। অপর দিকে প্রাচীন ভারতীয় ও অন্যান্য সংস্কৃতিতে তাদের ভেষজ ব্যবহার থাকলেও (যদিও তাদের যথাযথ বিবরণ, নাম, ইত্যাদি তথ্য হয় অস্পষ্ট নয়তো অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের শনাক্তকরণ অসম্ভব জটিল) তা আধুনিক বিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক চোখে পরীক্ষিত নয়। তাই একটি মাত্র উদ্ভিদের সম্বন্ধে লিখতেও পাহাড় প্রমাণ গবেষণা করতে হচ্ছে। আরও একটি অসুবিধার কারণ উদ্ভিদবিদ্যা সম্বন্ধে আমার প্রথাগত শিক্ষার অভাব (আমি পেশায় একজন অধ্যাপক, বিদ্যুৎ প্রকৌশল ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাদি বিষয়ক)। তবুও আমার মত নেহাতই একজন শখের ভেষজপ্রেমীর কাজ যদি ভবিষ্যতে কোন যোগ্যতর ভেষজবীদের এ বিষয়ে বিশদ গবেষণার আগ্রহ জন্মাতে স্বার্থক হয়, তবে আমার পরিশ্রম সফলজ্ঞান করব ।

এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, ছোট থেকেই আরেকটি শখ (প্রাচীন বস্তু খুঁজে বার করার প্রচেষ্টা) এর বশে বেশ কিছু পুরোনো ধ্বংসস্তূপে অনুসন্ধান করে খুঁজে পেয়েছিলাম বেশ কিছু পুঁথি (যেগুলি বর্তমানে এশিয়াটিক স্যোশাইটির কাছে গচ্ছিত)। যার মধ্যে একটি অতি দুর্লভ ছবি যুক্ত পুঁথিও ছিল, ছবিগুলি কালি দিয়েই আঁকা, খুব স্পষ্ট নয়, দেখতে উদ্ভিদের মতই। এশিয়াটিক স্যোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ ঘটার আগেই আমি পুঁথি প্রাপ্তিস্থানের নিকটবর্তি হুগলির পুরশুড়া গ্রামে হারান কবিরাজ (হারান ভট্টাচার্য্য) নামে অশীতিপর এক আয়ুর্বেদাচার্য্যের সন্ধান পাই। তিনি পুঁথিটির ভাষ্য উদ্ধার করতে সমর্থ না হলেও তাঁর সঙ্গে আমার দাদু-নাতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং মূলত তাঁর কারণেই পরবর্তিতে আমার বিভিন্ন উদ্ভিদের ঔষধি গুণ সম্বন্ধে আগ্রহ জন্মায়। তিনি আজ নেই, তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই সিরিজটি নিবেদন করে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার সামান্য প্রচেষ্টা করলাম।

হারান দাদু আমায় বিভিন্ন গাছ চিনিয়েছিলেন, এতে আজীবন উদ্দানপ্রেমী আমার মাতামহেরও যথেষ্ঠ উৎসাহ ছিল। তবে সেসময় অপরিণত বুদ্ধির কারণে তাঁর চেনানো উদ্ভিদগুলির কোন নির্দিষ্ট নোট নেওয়া নেই। তাই উদ্ভিদগুলি ও তাদের কিছু কিছু লোকায়ত ব্যবহার মনে থাকলেও তাদের নাম গুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিস্মৃত হয়েছি। একারণেই বর্তমানে নতুন করে সেগুলি নিয়ে খোঁজখবর করার জন্য প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য বই (এ ক্ষেত্রে ফেসবুক গ্রুপ মলাটের অবদান নতমস্তকে স্মরণ করি), ইন্টারনেটের (ফেসবুক গ্রুপ বৃক্ষকথার কাছে অনন্ত কৃতজ্ঞ) সাহায্য নিয়েছি।

আজকে যে উদ্ভিদটির কথা বলব তার কোন নির্দিষ্ট বাংলা নাম নেই। অনেক জায়গায় এটিকে বনপালং বলে উল্লেখ করা হলেও আসল বনপালং (Rumex crispus) সম্পূর্ণ আলাদা একটি উদ্ভিদ। হারাণ দাদু এর নাম যতদূর মনে করতে পারি বলেছিলেন “দুধেরা” বা “দুদরোয়া” কিন্তু আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির ওপর খুব একটা নির্ভর করতে পারছি না। তাই এর নাম রাখলাম “মূলা পাতা”, কারণ এর অপরিণত পাতাগুলি অনেকটাই মূলার পাতার মত দেখতে, এছাড়াও নেপালে অনেক অঞ্চলে এটি “মূলা-পাত্তে” (मुलापाते) বলে পরিচিত। তবে এক্ষেত্রে একটি আগ্রহদ্দীপক তথ্য দিয়ে রাখি, নেপালের অনেক অঞ্চলে এটি কিন্তু “দুধে” (दुधे) বা “বন-রায়া” (बन रायो) বলেও পরিচিত।

এই উদ্ভিদটির সম্বন্ধে বলা হারাণ দাদুর কথাগুলির মধ্যে যেটি মনে আছে তা হল, যে এটি পাকস্থলী ও যকৃত দৌর্বল্য, মধুমেহ ইত্যাদি কঠীন রোগের ক্ষেত্রে ফলদায়ক, এছাড়াও এটি অনিয়মিত ঋতুর ক্ষেত্রেও বিশেষ উপকারী। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায় এটির নিরাময় ক্ষমতার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে এর পরিচয় খোঁজার ক্ষেত্রে খুবই সমস্যায় পড়লাম, নাম না মনে থাকায়। উদ্ভিদটির প্রথম যা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল সূর্যমুখী সদৃশ দৃষ্টি নন্দন ফুল। তাই সেই ফুলের ছবি ফেসবুকের বৃক্ষকথা গ্রুপে পোস্ট করে সাহায্য চাইলাম। সেখানে সমাপ্তি ভট্টাচার্য্য ঠাকুর লিখলেন যে এটি ব্লুমিয়া গোত্রের উদ্ভিদ। ব্লুমিয়ার সঙ্গে আমার আদৌ পরিচয় না থাকায় ইন্টারনেট সহায়ে বেশ কিছু পড়া-শোনা করে মূলা-পাতার ফুলের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে এমন একটি ব্লুমিয়া গোত্রের ফুল খুঁজে পাওয়া গেল। এই ব্লুমিয়াটি (Blumea Lanceolaria) মিজোরাম অঞ্চলে জন্মায় ও আঞ্চলিক ভাষায় “তেরাপাইব্বি” নামে পরিচিত। কিন্তু সম্পূর্ণ উদ্ভিদের ছবি দেখে বুঝলাম এটি আমার পরিচিত উদ্ভিদটি নয়। তবে উদ্ভিদের বিবরণে আরেকটি লাইনে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, তা হল এই তেরাপাইব্বি কে “মিজোরামের ড্যান্ডেলিয়ান” বলা হয়।

ড্যান্ডেলিয়ন বহু ভেষজগুণসম্পন্ন একটি উদ্ভিদ, তবে তার ফুলের সঙ্গে পরিচিত হলেও পুঙ্খানুপুঙ্খ গঠন আগে কখনও বিচার করে দেখিনি। ইন্টারনেটের সহায়তায় খুঁটিয়ে দেখে এর একটি প্রজাতির (Taraxacum officinale) সঙ্গে আমাদের আলোচ্য উদ্ভিদের ফুলের সম্পূর্ণ মিল খুঁজে পেলাম। কিন্তু আবার নিরাশ হতে হল এর সম্পূর্ণ উদ্ভিদের গঠন দেখে, যা বেশ কিছু সাযুজ্য থাকলেও কখনই আমাদের আলোচিত উদ্ভিদটি নয়।

এর পর অনুসন্ধান করতে গিয়ে অত্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম কারণ এই রকম পুষ্প সম্বলিত একাধিক উদ্ভিদ আছে, যাদের নিজেদের গঠনের মধ্যে নানা সাযুজ্য থাকলেও তারা আলাদা গোত্রের, এবং কোন ভাবেই আমাদের আলোচ্য উদ্ভিদটি নয়। এদের মধ্যে হকউইড (Crepis pulchra) ও বিড়ালকর্ণীর (Hypochaeris radicata) কথা উল্লেখযোগ্য। অবশেষে অনেক অনুসন্ধানের পর আমাদের আলোচ্য উদ্ভিদটি, যার নাম দেওয়া হল মূলা-পাতা সেটিকে Sonchus wightianus হিসাবে শনাক্ত করা গেল। এক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত কিন্তু দারুণ তথ্যও এই সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, এই ধরণের ফুল যুক্ত যে যে উদ্ভিদগুলি দেখলাম তারা আলাদা আলাদা গোত্রের হলেও দু একটি বাদ দিয়ে প্রায় সবকটিই ভেষজ গুণাবলি যুক্ত হওয়া ছাড়াও খাদ্যযোগ্য এবং পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তাদের ভোজ্য শাক হিসাবে প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহারের প্রমাণ আছে।

বিশেষ অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম, মূলা-পাতা ও ড্যান্ডেলিয়ান খুবই কাছাকাছি আত্মীয়। দুটিই একই পরিবারভুক্ত বলা চলে (Cichorieae)। তাই দুটির মধ্যে ফুল, পাতার গঠন, বীজ ছড়ানোর পদ্ধতি, বাসস্থান, আগ্রাসী প্রকৃতি ও ভেষজ গুণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসংখ্য সাযুজ্য দেখা যায়। যদিও এখনও মূলা-পাতা নিয়ে সেভাবে গবেষণা হয়নি তবে যদি সত্যিই ড্যান্ডেলিয়নের মত ভেষজ গুণ মূলা-পাতায় থেকে থাকে, তবে তা হবে আমাদের উপমহাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ড্যান্ডেলিয়ানের স্পষ্ট উল্লেখ আছে সিংহদন্তী নামে (এর পাতার আকার সিংহের দাঁতের মত খাঁজ কাটা বলে)। অসংখ্য প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সিংহদন্তীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন – চক্রদত্ত, সুশ্রুত, চরকসংহিতা, হরিৎসংহিতা, বাস্তুগুণদীপিকা, বাস্তুগুণপ্রকাশিকা ইত্যাদি। তাই মূলা-পাতার ভেষজ গুণ সম্বন্ধে আলোচনার আগে দেখে নেওয়া যাক ড্যান্ডেলিয়নের বিভিন্ন ব্যবহার ও ভেষজ গুণ।

ড্যান্ডেলিয়ান ফুলের সঙ্গে সূর্যমুখী ফুলের খুব মিল থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে অন্য একটি পরিচিত ফসলের সঙ্গে কিন্তু এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তা হল লেটুস, যে কারণে ড্যান্ডেলিয়ান গোত্রিয় বেশ কয়েকটি উদ্ভিদ বন্য লেটুস, তেঁতো লেটুস ইত্যাদি নামেও পরিচিত। প্রায় ১৫০০০ বছর আগেকার কয়েকটি ফসিলে ড্যান্ডেলিয়ানের অস্তিত্বের নমুনা পাওয়া গেছে, অতয়েব বলা ই যায় এটি যথেষ্ট পুরানো একটি উদ্ভিদ। প্রাচীন কাল থেকেই এর ব্যবহার মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য হিসাবে হয়ে আসছে। তবে এর স্বাদ যথেষ্ট তিক্ত। প্রাচীন কালেও এর তিক্ত স্বাদ বদলাবার উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ বহু বছর ধরে নির্বাচিত রোপন (সিলেক্টিভ ব্রীডিং) পদ্ধতিতে অপেক্ষাকৃত কম তিক্ত প্রজাতিগুলির সন্ধান ও রোপনের মাধ্যমে আজকের লেটুসের সৃষ্টি হয়েছে।

ড্যান্ডেলিয়ান সাধারণতঃ কবোষ্ণ (নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল, যেখানে শীত ও গ্রীষ্ম ছাড়াও শরত ইত্যাদি ঋতু গুলির আবহাওয়া পরিবর্তন স্পষ্ট) অঞ্চলে জন্মায়। কোন কোন অঞ্চলের আবহাওয়া ড্যান্ডেলিয়ান জন্মানোর উপযোগী, তার সমীক্ষা করে প্রকাশিত ভৌগলিক মানচিত্রে ভারতের উত্তরপূর্বের অনেকাংশ এবং বাংলাদেশের বেশ কিছুটা অঞ্চলও কিন্তু ড্যান্ডেলিয়ান জন্মানোর উপযুক্ত পরিবেশ বলে দর্শিত হয়েছে।

ড্যান্ডেলিয়ান সাধারণতঃ নদীর ধার, জলা জমির পাড়, রাস্তার পাশে, ফাঁকা জমিতে সর্বত্র জন্মাতে পারে এবং বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে, অ্যাসিডিক মৃত্তিকাতে, কম জলের যোগানেও টিকে থাকতে পারে। এই সব কারণেই আমেরিকা ও ইউরোপের যে অঞ্চলগুলিতে এটি জন্মায়, সেখানকার কৃষকরা এটিকে আগাছা বলেই মনে করেন।

মজার ব্যাপার হল ড্যান্ডেলিয়ান প্রধানত ইউরোপ ও এশিয়ার উদ্ভিদ হলেও আমেরিকাতে প্রথম ড্যান্ডেলিয়ান নিয়ে যাওয়া হয় খাদ্য শষ্য হিসাবেই। আগেই বলেছি এটি প্রাচীন কাল থেকেই শাক হিসাবে খাওয়ার চল ছিল বিভিন্ন সংস্কৃতিতে। ড্যান্ডেলিয়ান গাছের সবুজ অংশ পুষ্টিগুণে ভরপুর। একটু তালিকাটা দেখে নেওয়া যাক –

প্রতি ১০০ গ্রামে পুষ্টিগুণ – ৩.৫ আউন্স, এনার্জী ২৫ কিলোক্যালরি , কার্বোহাইড্রেট ৯.২ গ্রাম , শর্করা ০.৭২ গ্রাম , পৌষ্টিক ফাইবার   ৩.৫ গ্রাম , ফ্যাট ০.৭ গ্রাম , প্রোটিন ২.৭ গ্রাম ,

ভিটামিন এর পরিমাণ : ভিটামিন এ – ৫০৮ মাইক্রোগ্রাম , বেটা ক্যারোটিন – ৫৮৫৪ মাইক্রোগ্রাম, ল্যুটেনিন জেক্স্যান্থিন – ১৩৬১০ মাইক্রোগ্রাম, থায়ামিন (ভিটামিন বি ১) – ০.১৯ মিলিগ্রাম, রাইবোফ্ল্যাভিন (ভিটামিন বি ২) – ০.২৬ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন (ভিটামিন বি ৩) – ০.৮০৬ মিলিগ্রাম, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি ৫) – ০.০৮৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ৬ – ০.২৫১ মিলিগ্রাম, ফোলেট (ভিটামিন বি ৯) – ২৭ মাইক্রোগ্রাম, ক্লোইন – ৩৫.৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি – ৩৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ই – ৩.৪৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে – ৭৭৮.৪ মাইক্রোগ্রাম,

খনিজের পরিমাণ : ক্যালসিয়াম – ১৮৭ মিলিগ্রাম, আয়রন – ৩.১ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম – ৩৬ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ – ০.৩৪২ মিলিগ্রাম , ফসফরাস – ৬৬ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম – ৩৯৭ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম – ৭৬ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক – ০.৪১ মিলিগ্রাম

এছাড়াও উদ্ভিদটি অত্যন্ত রস বা জল সমৃদ্ধ ।

ঠিক এই কারণেই এই উদ্ভিদটি বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন রকম ভাবে ব্যবহার করে থাকেন। বিভিন্ন দেশের বাজারে ড্যান্ডেলিয়ান বেশ উচ্চমূল্যে বিক্রিও হয়। শাক ভাজা হিসাবে খাওয়া ছাড়াও, কাঁচা পাতা স্যালাড হিসাবে বেশ জনপ্রিয়। কচি পাতা ও সিদ্ধডিমের একটি পদ তো রীতিমত ডেলিকেসি। এছাড়াও এর ফুল উৎকৃষ্ট সুরা, পানীয়, জ্যাম জেলী, মধু-বিকল্প ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়।

ড্যান্ডেলিয়ানের শিকড় চূর্ণ উৎকৃষ্ট কফি বিকল্প হিসাবে ব্যবহার হয়। আর যেহেতু এই কফির স্বাদ কফির মতই কিন্তু ক্যাফেইন অনুপস্থিত, তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।

এবার আসি এর নিরাময়ক গুণগুলির আলোচনায়। বিভিন্ন সংস্কৃতির বিশ্বাস অনুযায়ী ড্যান্ডেলিয়ান একটি যাদুময় উদ্ভিদ। এর বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আমি আগেই বলেছি প্রচলিত বিশ্বাস গুলিকে আধুনিক বিজ্ঞানের আতসকাঁচের তলায় ফেলে যাচাই করে নেব।

আমাদের অনেকের কাছেই ল্যাসিক্স (Furosemide) একটি পরিচিত নাম, সাধারণতঃ রোগির প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে ভারতীয় হাসপাতালগুলিতে এই ওষুধটি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয় প্রস্রাব নিঃসরণ বৃদ্ধি করার জন্য। এটি একটি diuretic জাতীয় ওষুধ। Diuretic আরও বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, যকৃত ও কিডনির রোগ ইত্যাদি। এছাড়াও প্রিডায়াবেটিক (অর্থাৎ যার অদূর ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হতে চলেছে) রোগির ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়ে থাকে। ড্যান্ডেলিয়ানের মূত্রকারক গুণের কথা প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের জানা ছিল। বিশেষতঃ কাব্যপ্রিয় ফরাসীরা তো এর নামই দিয়ে দিয়েছিল “শয্যাসিক্তকারক” (pissenlit)। বর্তমানে ২০০৯ সালের একটি গবেষণায় (https://www.liebertpub.com/doi/10.1089/acm.2008.0152) যদিও দেখা গেছে যে এটি মানুষকে বার বার প্রস্রাবে যেতে বাধ্য করলেও সমগ্র নিঃসারিত মূত্রের পরিমাণ একই থাকে। তাই মূত্র বেশী পরিমাণে তৈরিতে এটি কার্য্যকর নয়, যদিও মূত্রথলীর পেশীর কোন সমস্যার জন্য মূত্র বন্ধ হয়ে গেলে এটি যথেষ্ট কার্যকারী। তবে এবিষয়ক আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ড্যান্ডেলিয়ানের নির্যাস ও বাঁটা শিকড়ের প্রলেপ দাদ, একজিমা, ব্রণ সহ বিভিন্ন চর্মরোগের নিরাময় করতে সক্ষম। এমনকি চামড়ার ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম। এখন দেখা যাক বর্তমান গবেষণা কি বলে এ বিষয়ে। আশ্চর্য্যজনক ভাবে ২০১৫ সালের প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফলে (https://www.hindawi.com/journals/omcl/2015/619560/) দেখা যাচ্ছে যে ড্যান্ডেলিয়ানের প্রলেপ ত্বকের জ্বালা, কন্ড্যূয়ণেচ্ছা (চুলকানি) কমাতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এটি সূর্যের ক্ষতিকারক আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির প্রভাব থেকে ত্বক কে রক্ষা করে, ফলে ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।

প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ সহ বিভিন্ন দেশের প্রাচীন ভেষজবীদগণ মধুমেহ বা ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণে সিংহদন্তীর ব্যবহারের কথা বলে গিয়েছেন। ২০১৬ সালের ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় (https://doi.org/10.1900/RDS.2016.13.113) উঠে এসেছে, ড্যান্ডেলিয়ানের শিকড়ের নির্যাসে ইন্যুলিন নামক এক ধরণের ডায়েটরি ফাইবার বর্তমান যা পাচনক্রিয়ায় কিছু প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রক্তে শর্করা যোগ হওয়ার প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়, ফলশ্রুতিতে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। আবার অন্যদিকে এর মধ্যে থাকা একটি অভূতপূর্ব জৈব যৌগ (বিজ্ঞানীরা এর গঠন সম্বন্ধে এখনও নিশ্চিত নন) অগ্ন্যাশয়ের কোষ গুলিকে বেশী মাত্রায় ইন্স্যুলিন ক্ষরণে সাহায্য করে, ফলে বাইরে থেকে ইন্স্যুলিন নেওয়ার পরিমাণ কমে।

ড্যান্ডেলিয়ানের যকৃতের অসুখে উপকারীতার কথা বার বার উঠে এসেছে প্রাচীন আয়ুর্বেদ ও ইউনানী শাস্ত্রে। যদিও এতদিন একটি গবেষণায় (https://doi.org/10.3390/molecules22091409) সামান্য কিছু প্রমাণ পেলেও কার্য্য কারণের যথার্থ প্রয়োগ ও প্রমাণের অভাবে এই দাবীর সারবত্তা বিচার করা সম্ভব হয় নি। তবে ২০১০ সালে ইঁদুরের ওপর গবেষণায় (https://doi.org/10.1016/j.jep.2010.05.046) বেশ কয়েকটি আশ্চর্য্য বিষয় পরিলক্ষিত হয়। দেখা যায়, ড্যান্ডেলিয়ান শিকড়ের নির্যাস ইঁদুরের যকৃতের ফাইব্রোসিস (যা পরবর্তীতে ক্যান্সারের মত কঠীন অসুখের রূপ নেয়) অসম্ভব দ্রূততায় কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। ক্ষতিকর কোষগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে যকৃতের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটিকে ধীরে ধীরে নিরাময় হতে সাহায্য করছে। এই নিয়ে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।

আমাদের দেহের নিয়ম অনুসারে একটি কোষ বেশ কিছুদিনের পুরোনো হয়ে যাওয়ার পর তার মৃত্যু ঘটে, তার জায়গা নেয় নতুন একটি কোষ, এই ঘটনাকে কোষের প্রোগ্রামড ডেথ বা অ্যাপোপটোসিস বলে। কিন্তু ক্যান্সার কারক কোষ বা টিউমারের ক্ষেত্রে এই নিয়মানুযায়ী মৃত্যু ঘটেনা। সেটি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং একটি বিশেষ পদার্থের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশের কোষগুলির মধ্যেও এইরকম প্রবণতা ছড়িয়ে দেয়। ২০১২ সালের কানাডার উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় (https://doi.org/10.1097/MPA.0b013e31824b22a2) দেখা গেছে ড্যান্ডেলিয়ানের শিকড়ের নির্যাস অগ্ন্যাশয় ও প্রস্টেটের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে টিউমার কোষটিকে অ্যাপোপটোসিস বা প্রোগ্রামড ডেথে বাধ্য করে। অন্য আরেকটি গবেষণায় (https://doi.org/10.18632/oncotarget.11485) এটাও দেখা গেছে যে ড্যান্ডেলিয়ানের অনুরূপ কিছু প্রজাতির এই রকম শিকড়ের নির্যাস কিছু বিশেষ লিউকোমিয়া ও মেলানোমার ক্ষতিকারক কোষ গুলির অ্যাপোপটোসিস ঘটাতে সক্ষম। তবে এই যুক্তিগুলির সপক্ষে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে।

তবে এই সঙ্গে এটাও বলে রাখা দরকার বিভিন্ন গবেষণায় (https://doi.org/10.3205/000203) এটা দেখা গেছে যে বিভিন্ন বাজার চলতি ওষুধের সঙ্গে ড্যান্ডেলিয়ানের কিছু প্রতিক্রিয়া বা ইন্ট্যার‍্যাকশন আছে। তাই কোন ওষুধ ব্যবহার করার সময় ড্যান্ডেলিয়ান ব্যবহার করতে হলে এ বিষয়ে বিশেষ ভাবে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া উচিত। এছাড়াও ড্যান্ডেলিয়ানে থাকা একটি পদার্থ, ফাইটো ইস্ট্রোজেন, শরীরে ইস্ট্রোজেনের প্রভাব বৃদ্ধি করে, তাই এটি মহিলাদের (বিশেষত যাদের পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম রয়েছে) অনিয়মিত ঋতুতে বিশেষ উপকারী হলেও এটির গর্ভপাত করার ও পুরুষদের উর্বরতা হ্রাসের ক্ষমতা রয়েছে। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ড্যান্ডেলিয়ানে অ্যালার্জী ও তার প্রভাবে ত্বকে নানা উপসর্গ ও হজমের সমস্যা দেখা গেছে (https://doi.org/10.1016/j.jep.2015.03.067)।

যুক্তরাষ্ট্রে ঔষধের দোকানে ড্যান্ডেলিয়ান ক্যাপসুল হিসাবেও বিক্রয় হয়, এবং এটি একটি রেজিস্টার্ড ড্রাগ।

তাই আশা করি বুঝতেই পারছেন, বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশে ড্যান্ডেলিয়ানের সমগুণযুক্ত একটি উদ্ভিদ খুঁজে পাওয়া (যেটি আবার বিনা যত্নেই যেখানে সেখানে বেড়ে ওঠে) কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

এবার আসা যাক আমাদের মূল আলোচ্য উদ্ভিদ মূলা-পাতার কথায়। মূলা-পাতা একটি সঙ্কাস বা চলতি কথায় থিসল গোত্রের উদ্ভিদ। এর অন্য কয়েকটি প্রজাতি যেমন – Sonchus oleraceus , Sonchus arvensis ইত্যাদি বিশ্বের বহু দেশে স্যালাড হিসাবে খাওয়া হয়। এদের পাতার স্বাদও ড্যান্ডেলিয়ানের মতই তীক্ত। এছাড়া প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এদের ড্যান্ডেলিয়ানের মতই অনিয়মিত ঋতু নিরাময়ে, মধুমেহ নিয়ন্ত্রণে ও হজম সংক্রান্ত সমস্যা দূরিকরণে সদর্থক ভূমিকা আছে বলে জানা যায়।

মূলা-পাতা (Sonchus wightianus) সংক্রান্ত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে প্রত্যক্ষ কোন নথি আমি পাইনি, এর একটি কারণ হতে পারে এর সঠিক নামটি না জানা, তবু স্থানভেদে প্রচলিত এর ভেষজ ব্যবহারগুলি জানার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিশেষতঃ নেপালে এই উদ্ভিদের পাতার বহুল ব্যবহার হয় জ্বর নিরাময়ে। এছাড়াও প্রদাহ এবং সোয়েলিং বা ফুলে যাওয়া কমাতে, কর্ণপ্রদাহে এর পাতার ব্যবহার হয়। শিকড় মূলতঃ হজমের সমস্যায়, পেটে ব্যাথায়, জন্ডিস, হাঁপানি, হুপিং কফ ও ব্রঙ্কাইটিসে ব্যবহার হয়। ইন্দোনেশিয়ায় এটি বৃক্কের পাথর ও জন্ডিস নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।

এবার দেখা যাক, গবেষণায় উপরিউক্ত দাবি গুলির কোন প্রমাণ মেলে কিনা। মূলা-পাতা অর্থাৎ Sonchus wightianus এ সঙ্কাস গোত্রিয় অন্যান্য উদ্ভিদগুলি যেমন Sonchus oleraceus , Sonchus arvensis ইত্যাদির থেকে অনেক বেশী পরিমাণে ট্যার‍্যাক্সাস্টেরল ও ইনোসিটল (taraxasterol and inositol) থাকে। যা ড্যান্ডেলিয়ানেও একই রকম ভাবে বর্তমান। ইনোসিটল বিভিন্ন জটিল রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর বলে বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলত্ব, মধুমেহ , সর্বোপরি মেটাবলিক সিন্ড্রোমে, সেইসঙ্গে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমে। এছাড়াও বৈজ্ঞানিকরা এটির বিভিন্ন মানসিক রোগ, যেমন প্যানিক অ্যাটাক, ডিপ্রেশন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও কার্যকর হওয়ার সম্ভবনা আছে বলে মনে করেন। তবে এর সপক্ষে কোন জোরালো যুক্তি বা প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি। অন্যদিকে ট্যার‍্যাক্সাস্টেরল অ্যাপোপটোসিস এর মাধ্যমে ক্যান্সার কোষগুলিকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা রাখে। এছাড়াও এটি জীবাণুনাশক, প্রদাহনাশক, মধুমেহের ক্ষেত্রেও কার্যকারী। এমনকি এটির বেশ কিছু সাপের বিষের প্রতিষেধক হিসাবেও কিছু ভূমিকা থাকতে পারে বলে বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন। এই দুটি যৌগই কিডনির পাথরের ক্যালসিয়ামের অংশটি ক্ষয় করতে সক্ষম।

বর্তমান একটি গবেষণায় (https://ijpsr.com/bft-article/human-ache-selective-inhibition-of-phytochemicals-of-sonchus-wightianus-of-nepal-origin-an-in-silico-approach/?view=fulltext) দেখা গেছে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ক্রমবর্ধমান ও ভয়ংকর রোগ অ্যালঝাইমার্সের ক্ষেত্রে প্রচলিত ঔষধ acetylcholinesterase (AChE) inhibitors এর বর্তমান বাজার চলতি ধরণ গুলির থেকে বেশী শক্তিশালী AChE মূলা-পাতায় পাওয়া সম্ভব।

সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণায় (https://pdfs.semanticscholar.org/01c1/a8657ac3748e09cfba6026ac7bed89e119bd.pdf?_ga=2.132921870.1659048542.1613220090-719495840.1613220090) দেখা গেছে মূলা-পাতায় সহ  বিভিন্ন এমন জৈব যৌগ উপস্থিত, যা পারকিনসন্স, ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি সহ বিভিন্ন অসুখে কার্যকর হতে পারে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।

একটি যৌথ গবেষণায় (https://li01.tci-thaijo.org/index.php/cast/article/download/135392/101175/ এবং https://www.researchgate.net/profile/Reshmi_Chatterjee4/publication/331161985_Establishment_of_Quality_Parameters_for_Leaf_Stem_and_Root_of_Sonchus_wightianus_DC_through_Pharmacognostical_Standardization/links/5c6996b9a6fdcc404eb72fe4/Establishment-of-Quality-Parameters-for-Leaf-Stem-and-Root-of-Sonchus-wightianus-DC-through-Pharmacognostical-Standardization.pdf?origin=publication_detail) মূলা-পাতার হজম সংক্রান্ত সমস্যা ও ডায়েরিয়া নিরাময়ের অবিশ্বাস্য ক্ষমতার কথা প্রমাণিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এই গবেষণায় এটিও দেখা গেছে যে এই উদ্ভিদটি বিষাক্ত নয়।

অতয়েব বলাই বাহুল্য যে ভারতীয় উপমহাদেশে ড্যান্ডেলিয়ান বা সিংহদন্তী সহজলভ্য না হলেও মূলা-পাতা যথেষ্ট সহজলভ্য এবং ভবিষ্যতে এটির থেকে নানা অসাধারণ কিন্তু সুলভ ঔষধ বানানো হয়ত সম্ভব, সেজন্য প্রয়োজন নবীন গবেষকদের এগিয়ে আসা ও এ সম্বন্ধে গবেষণা প্রয়োজন।

বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ – এই প্রবন্ধটি গবেষণাধর্মী, বন্য ভেষজ কোন অভিজ্ঞ আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও প্রত্যক্ষ নিরুপণ ব্যতীত ভক্ষণ বা ব্যবহার করা উচিত নয়।

© শতদ্রু ব্যানার্জ্জী

নুনশাক, এক অবহেলিত বন্ধু

আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে এমন অনেক লতা-গুল্ম যাদের আমরা আগাছা বলে অবজ্ঞাই করে এসেছি চিরকাল, কিন্তু তাদের অদ্ভুত ভেষজ গুণের অজানা কাহিনী রয়ে গেছে আমাদের অগোচরে। সেরকমই কিছু অচেনা বন্ধুদের তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করব এই দুর্বল কলমসহায়ে। আজ প্রথম কিস্তিতে থাকুক, আমাদের বাড়ির আশেপাশের অযাচিত ভাবেই জন্মানো, অনাদরে বেড়ে ওঠা এই প্রতিবেশী।

এটি সংস্কৃতে লোণিকা নামে পরিচিত। বাংলায় কেউ বলে নুন শাক, কেউ বলে নুনে শাক, আবার কেউ বলে নুনিয়া বা নুন্তা শাক, ওড়িয়ায় বলে পুরনিশাক, হিন্দিতে খুরসা বা কুলফা । বিজ্ঞান সম্মত ল্যাটিন নাম – Portulaca oleracea ।

এটি আমার মতে একটি মিরাক্যাল গাছ। সব দিক থেকে প্রকৃতি ও মানুষের উপকারী একটি গুল্ম। এটি প্রবল খরাতেও নিজের বিপাকীয় ধরণ পরিবর্তন করে টিকে থাকতে পারে। মাটির আদ্রতা ধরে রেখে অন্যান্য গাছকে বাঁচতে সাহায্য করে। হয়ত এত গুণের জন্যই সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে মানুষ এটিকে সৌভাগ্যের প্রতিক হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে নানা সভ্যতায়। তারা যে শুধু এটিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করত তাই নয়, অনেক সংস্কৃতিতে মনে করা হত, এই গাছ অপদেবতা ও বিপদকে দূরে রাখে।

এবার আসি এর ভেষজ ও খাদ্যগুণের কথায়, প্রথমেই বলি খাদ্যগুণ। নুনে শাক এর পাতা, ফুল, কান্ড পুরোটাই কাঁচা বা রান্না করে দুভাবেই খাওয়া যায়। গ্রীস, ফ্রেঞ্চ ও বেশ কিছু ইউরোপিয় সংস্কৃতিতে এটিকে স্যালাড হিসাবে টমেটো ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার চল ছিল। স্পেনে স্যুপ, স্ট্যু ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হত এটি আর মেক্সিকোতে তো এই শাক দিয়ে একদম মৌলিক একটা চিকেনের পদই জনপ্রিয় ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় এর ছোট্ট ছোট্ট পোস্তদানার মত বীজগুলি সংগ্রহ করে বেঁটে বড়া বানানো হত। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটিকে ভাজা, সিদ্ধ বা পালংশাকের মত করে রান্না করে খাওয়ার চল আছে।

নুনে শাকের টক – নোনতা স্বাদটি আসে মূলতঃ এর মধ্যে থাকা দুটি অ্যাসিডের কারণে, অক্সালিক অ্যাসিড ও ম্যালিক অ্যাসিড। এই ম্যালিক অ্যাসিড আমাদের অতি পরিচিত ফল আপেলেও থাকে। নুনে শাকে ভোরের দিকে ম্যালিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশী থাকে। তাই ঐ সময়ে এই শাক তুললে তা বেশী ম্যালিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ হয়।

১০০ গ্রাম পরিমাণ এই শাক ২০ ক্যালরি শক্তি দিতে পারে মানবদেহে। প্রায় ২ গ্রাম মত প্রোটিন ও খুবই সামান্য ফ্যাট থাকে। এছাড়াও এর থেকে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মৌলগুলিও যথেষ্ট মাত্রায় পাওয়া যায়। এছাড়াও এর থেকে আমাদের অপরিহার্য্য ভিটামিনগুলির (Vitamin A, B1, B2, B3, B6, B9, C, E etc.)  প্রাত্যহিক চাহিদার ২০ শতাংশেরও অধিক পাওয়া যায়।

 

এবার আসি ভেষজগুণে —

১) গনোরিয়ায় – এই বিরক্তিকর যৌনরোগটিতে একটি ভয়ঙ্কর উপসর্গ হল প্রস্রাব ঘোলাটে হওয়া এবং অতিরিক্ত পিপাসা। এক্ষেত্রে ১০ গ্রাম নুনেশাক ৪ কাপ জল দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে ২ কাপ করতে হবে, এর পর ওটাকে ছেঁকে ঠান্ডা করে সকালে বিকেলে এক কাপ করে খেতে হবে প্রতিদিন। এটি ডায়াবেটিসের কিছু ক্ষেত্রেও সমান ধরনের উপসর্গের উপশম করতে সক্ষম।

২) বাচ্চাদের কাশি হলে – নুনশাকের রস একটু গরম করে ঠান্ডা হলে ১৫ ফোঁটা সেই রসে ৫ ফোঁটা মধু মিশিয়ে সিরাপ তৈরি করা যায়। এটি দিনে ৩-৪ বার করে খাওয়ালে সাধারণ কাশি হলে ২-১ দিনের মধ্যে কাশি ভাল হয়ে যাবে। এছাড়াও শিশুদের অম্বল, আমাশয়েও এই সিরাপ সকালে ও সন্ধ্যায় ২-৪ ফোঁটা খাওয়ালে উপকার হয়।

৩) তোতলামিতে – দন্ত্য বর্ণ,  ওষ্ঠ বর্ণ বাদ দিয়ে বিশেষ কোন বর্গের অন্তর্গত বর্ণ গুলি (যেমন মূর্ধা বর্ণ) উচ্চারণে সমস্যা থাকলে নুনে শাকের রস দুচামচ পরিমাণ অন্ততঃ ১৫ মিনিট মুখে নিয়ে বসে থাকলে অনেকটা উপকার হয়।

৪) চোখ ওঠা বা চোখ লাল হওয়ায় – নুনেশাকের রস ছেঁকে যে স্বচ্ছ রস পাওয়া যায় তাকে সামান্য গরম করে ঠান্ডা করে একফোঁটা করে ২ – ৩ দিন দিলে উপশম হয়।

৫) চুলকানি ও বিষাক্ত কীট দংশনে – সাধারণ চুলকানিতে এবং বোলতা মৌমাছি পিঁপড়ে ইত্যাদি কামড়ালে, শুঁয়ো লাগলে কিম্বা বিছুটি আলকুশি ইত্যাদি লেগে চুলকালে নুনেশাক বেঁটে অল্প গরম করে প্রলেপ দিলে কার্যকরী হয়। তবে ভীমরুল বা কাঁকড়াবিছের বেলায় কিন্তু এটি নিষ্ক্রিয়।

৬) অর্শ্ব, বদহজম, কোলাইটিস ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে নুনেশাক খাদ্য হিসাবে উত্তম যা এই রোগগুলির নিরাময় করে।

৭) নুনেশাকের বীজ জল দিয়ে খেলে তা ক্রীমি নাশ করে।

এছাড়াও এটি শরীরের বলকারক, তৃষ্ণা নিবারক, চোট আঘাত জনিত ফুলে যাওয়া বা সোয়েলিং কমাতে অত্যন্ত্য কার্য্যকারী।

পরিশেষে বলি, এমন যে গুণসম্পন্ন উদ্ভিত তাকে আমরা না চিনে প্রায়শঃই উপড়ে ফেলি নিতান্তি আগাছা ভেবে, তাই ভয় হয় অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এই বন্ধু হয়ত মানুষের সান্নিধ্য হারিয়ে আবার অরণ্যভূমীর গোপনিয়তাতেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে।

© শতদ্রু ব্যানার্জ্জী