নুনশাক, এক অবহেলিত বন্ধু

আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে এমন অনেক লতা-গুল্ম যাদের আমরা আগাছা বলে অবজ্ঞাই করে এসেছি চিরকাল, কিন্তু তাদের অদ্ভুত ভেষজ গুণের অজানা কাহিনী রয়ে গেছে আমাদের অগোচরে। সেরকমই কিছু অচেনা বন্ধুদের তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করব এই দুর্বল কলমসহায়ে। আজ প্রথম কিস্তিতে থাকুক, আমাদের বাড়ির আশেপাশের অযাচিত ভাবেই জন্মানো, অনাদরে বেড়ে ওঠা এই প্রতিবেশী।

এটি সংস্কৃতে লোণিকা নামে পরিচিত। বাংলায় কেউ বলে নুন শাক, কেউ বলে নুনে শাক, আবার কেউ বলে নুনিয়া বা নুন্তা শাক, ওড়িয়ায় বলে পুরনিশাক, হিন্দিতে খুরসা বা কুলফা । বিজ্ঞান সম্মত ল্যাটিন নাম – Portulaca oleracea ।

এটি আমার মতে একটি মিরাক্যাল গাছ। সব দিক থেকে প্রকৃতি ও মানুষের উপকারী একটি গুল্ম। এটি প্রবল খরাতেও নিজের বিপাকীয় ধরণ পরিবর্তন করে টিকে থাকতে পারে। মাটির আদ্রতা ধরে রেখে অন্যান্য গাছকে বাঁচতে সাহায্য করে। হয়ত এত গুণের জন্যই সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে মানুষ এটিকে সৌভাগ্যের প্রতিক হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে নানা সভ্যতায়। তারা যে শুধু এটিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করত তাই নয়, অনেক সংস্কৃতিতে মনে করা হত, এই গাছ অপদেবতা ও বিপদকে দূরে রাখে।

এবার আসি এর ভেষজ ও খাদ্যগুণের কথায়, প্রথমেই বলি খাদ্যগুণ। নুনে শাক এর পাতা, ফুল, কান্ড পুরোটাই কাঁচা বা রান্না করে দুভাবেই খাওয়া যায়। গ্রীস, ফ্রেঞ্চ ও বেশ কিছু ইউরোপিয় সংস্কৃতিতে এটিকে স্যালাড হিসাবে টমেটো ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার চল ছিল। স্পেনে স্যুপ, স্ট্যু ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হত এটি আর মেক্সিকোতে তো এই শাক দিয়ে একদম মৌলিক একটা চিকেনের পদই জনপ্রিয় ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় এর ছোট্ট ছোট্ট পোস্তদানার মত বীজগুলি সংগ্রহ করে বেঁটে বড়া বানানো হত। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটিকে ভাজা, সিদ্ধ বা পালংশাকের মত করে রান্না করে খাওয়ার চল আছে।

নুনে শাকের টক – নোনতা স্বাদটি আসে মূলতঃ এর মধ্যে থাকা দুটি অ্যাসিডের কারণে, অক্সালিক অ্যাসিড ও ম্যালিক অ্যাসিড। এই ম্যালিক অ্যাসিড আমাদের অতি পরিচিত ফল আপেলেও থাকে। নুনে শাকে ভোরের দিকে ম্যালিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশী থাকে। তাই ঐ সময়ে এই শাক তুললে তা বেশী ম্যালিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ হয়।

১০০ গ্রাম পরিমাণ এই শাক ২০ ক্যালরি শক্তি দিতে পারে মানবদেহে। প্রায় ২ গ্রাম মত প্রোটিন ও খুবই সামান্য ফ্যাট থাকে। এছাড়াও এর থেকে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মৌলগুলিও যথেষ্ট মাত্রায় পাওয়া যায়। এছাড়াও এর থেকে আমাদের অপরিহার্য্য ভিটামিনগুলির (Vitamin A, B1, B2, B3, B6, B9, C, E etc.)  প্রাত্যহিক চাহিদার ২০ শতাংশেরও অধিক পাওয়া যায়।

 

এবার আসি ভেষজগুণে —

১) গনোরিয়ায় – এই বিরক্তিকর যৌনরোগটিতে একটি ভয়ঙ্কর উপসর্গ হল প্রস্রাব ঘোলাটে হওয়া এবং অতিরিক্ত পিপাসা। এক্ষেত্রে ১০ গ্রাম নুনেশাক ৪ কাপ জল দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে ২ কাপ করতে হবে, এর পর ওটাকে ছেঁকে ঠান্ডা করে সকালে বিকেলে এক কাপ করে খেতে হবে প্রতিদিন। এটি ডায়াবেটিসের কিছু ক্ষেত্রেও সমান ধরনের উপসর্গের উপশম করতে সক্ষম।

২) বাচ্চাদের কাশি হলে – নুনশাকের রস একটু গরম করে ঠান্ডা হলে ১৫ ফোঁটা সেই রসে ৫ ফোঁটা মধু মিশিয়ে সিরাপ তৈরি করা যায়। এটি দিনে ৩-৪ বার করে খাওয়ালে সাধারণ কাশি হলে ২-১ দিনের মধ্যে কাশি ভাল হয়ে যাবে। এছাড়াও শিশুদের অম্বল, আমাশয়েও এই সিরাপ সকালে ও সন্ধ্যায় ২-৪ ফোঁটা খাওয়ালে উপকার হয়।

৩) তোতলামিতে – দন্ত্য বর্ণ,  ওষ্ঠ বর্ণ বাদ দিয়ে বিশেষ কোন বর্গের অন্তর্গত বর্ণ গুলি (যেমন মূর্ধা বর্ণ) উচ্চারণে সমস্যা থাকলে নুনে শাকের রস দুচামচ পরিমাণ অন্ততঃ ১৫ মিনিট মুখে নিয়ে বসে থাকলে অনেকটা উপকার হয়।

৪) চোখ ওঠা বা চোখ লাল হওয়ায় – নুনেশাকের রস ছেঁকে যে স্বচ্ছ রস পাওয়া যায় তাকে সামান্য গরম করে ঠান্ডা করে একফোঁটা করে ২ – ৩ দিন দিলে উপশম হয়।

৫) চুলকানি ও বিষাক্ত কীট দংশনে – সাধারণ চুলকানিতে এবং বোলতা মৌমাছি পিঁপড়ে ইত্যাদি কামড়ালে, শুঁয়ো লাগলে কিম্বা বিছুটি আলকুশি ইত্যাদি লেগে চুলকালে নুনেশাক বেঁটে অল্প গরম করে প্রলেপ দিলে কার্যকরী হয়। তবে ভীমরুল বা কাঁকড়াবিছের বেলায় কিন্তু এটি নিষ্ক্রিয়।

৬) অর্শ্ব, বদহজম, কোলাইটিস ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে নুনেশাক খাদ্য হিসাবে উত্তম যা এই রোগগুলির নিরাময় করে।

৭) নুনেশাকের বীজ জল দিয়ে খেলে তা ক্রীমি নাশ করে।

এছাড়াও এটি শরীরের বলকারক, তৃষ্ণা নিবারক, চোট আঘাত জনিত ফুলে যাওয়া বা সোয়েলিং কমাতে অত্যন্ত্য কার্য্যকারী।

পরিশেষে বলি, এমন যে গুণসম্পন্ন উদ্ভিত তাকে আমরা না চিনে প্রায়শঃই উপড়ে ফেলি নিতান্তি আগাছা ভেবে, তাই ভয় হয় অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এই বন্ধু হয়ত মানুষের সান্নিধ্য হারিয়ে আবার অরণ্যভূমীর গোপনিয়তাতেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে।

© শতদ্রু ব্যানার্জ্জী